বিরাট দল নিয়ে হজ্ব আদায়ের জন্যে পবিত্র মক্কা নগরীতে রওয়ানা হন। যিলহজ্ব মাসের ৪ তারিখ রোজ শনিবার মক্কা মুয়াজ্জামায় প্রবেশ করেন এবং শরীয়তের বিধাননুযায়ী হজ্ব সম্পাদন করেন। অতঃপর ৯ তারিখে মহানবী (স.) আরাফাতের বিশাল ময়দানে উপস্থিত প্রায় ১ লক্ষ ১৪ হাজার সাহাবীর সম্মুখে জীবনের অন্তিম ভাষণ দান করেন, যা বিশ্ব নবী (স.) এর 'বিদায় হজ্বের ঐতিহাসিক ভাষণ' নামে পরিচিত। ১। ধর্মীয় আদেশ নিষেধ মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করা :হে মানবমন্ডলী, তোমরা আমার কথাগুলো মনযোগ দিয়ে শ্রবণ কর, আমি তোমাদের জন্যে সমস্ত প্রয়োজনীয় বিষয় বর্ণনা করছি। আগামী বছর আমি এ স্থানে তোমাদের সাথে পুনরায় নাও মিলিত হতে পারি। ২। দেশের প্রতিটি নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা :হে বন্ধুগণ, স্মরণ রেখ, আজকের এ (জুম্মার) দিনে এর (জিলহ্জ) মাস এবং এ পবিত্র (মক্কা) নগরী তোমাদের নিকট যেমন পবিত্র তেমনী পবিত্র তোমাদের সকলের জীবন, তোমাদের ধনসম্পদ, তোমাদের রক্ত এবং তোমাদের মান মর্যাদা তোমাদের পরস্পরের নিকট। তোমরা যতদিন জীবিত থাকবে, ততদিন অন্যের ওপর অন্যায়ভাবে হস্তক্ষেপ করবে না। ৩। আমানতের খেয়ানত না করা :যে ব্যক্তি অন্যের ধন সম্পদের অভিভাবক বা আমানতদার, তার উচিত সম্পদের প্রকৃত মালিককে যথাযথভাবে পৌছে দেয়া। ৪। সুদ নিষিদ্ধকরণ:এখন থেকে সুদ দেয়া নেয়া হারাম করা হলো। আর এ উদ্দেশ্যে সর্বপ্রথম আমার চাচা আব্বাস বিন আব্দুল মুত্তালিবের সমূদয় সুদ বাতিল ঘোষণা করা হল। ৫। নারীর মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠাকরণ :হে লোক সকল, মনে রেখ, তোমাদের স্ত্রীদের ওপর তোমাদের যেমন অধিকার রয়েছে, তোমাদের ওপরও তাদের তেমন অধিকার রয়েছে। তোমাদের স্ত্রীদের সাথে উত্তম ব্যবহার করবে। তোমরা যা খাবে তাদেরকে তাই খেতে দিবে, তোমরা যা পরিধান করবে, তাদেরকে তাই পরিধাণ করতে দিবে। ভুেল যেওনা যে, তোমরা আল্লাহকে সাক্ষী রেখে তাদেরকে তোমাদের জীবন সংগিনী হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছ। ৬। জুলুম নির্যাতন বন্ধকরণ :তোমরা কারো প্রতি জুলুম করবে না। এটা তোমাদরে জন্যে কখনো বৈধ নয় যে, অনুমতি ব্যতীরেকে একে অন্যের সম্পদ গ্রহণ কর। ৭। ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠাকরণ :হে মানবমন্ডলী, তোমরা একের অন্যায়ে অন্যকে দায়ী করবে না। পিতার অপরাধের জন্য পুত্রকে এবং পুত্রের অপরাধের জন্য পিতাকে দায়ী করবে না। ৮। আভিজাত্যের গর্ব রহিতকরণ :হে লোক সকল মনে রেখ, কোন অনারবের ওপর আরবের এবং কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শেতাঙ্গের কোন প্রাধান্য নেই এবং তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্মানীত ঐ ব্যক্তি যিনি বেশী তাকওয়া অবলম্বনকারী। আভিজাত্যের গর্বে নবীজির নিজ বংশ কোরায়েশ ছিল সর্বাগ্রে। তাই বিদায় হজ্বের ভাষণে তিনি তার উচ্ছেদ করে বিচারে সকলকে সাব্যস্ত করেছিলেন। ৯। সাম্য প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ :হে লোকসকল, মনে রেখ মুসলমান সব ভাই ভাই। তোমাদের প্রভূ এক, তোমারা সবাই এক আদম (আ.) এর সন্তান তোমরা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইও না। মানবাধিকার ও ন্যায় বিচারে সকলে সমান পরিগণিত হবে। ১০। দ্বীনের পরিপূর্ণতা লাভ :আজকের এ দিনে আমি তোমাদের জন্যে দ্বীনকে পরিপূর্ন করলাম। তোমরা একে সঠিকভাবে অনুসরণ কর, তাহলে তোমরা কখনো পথভ্রষ্ট হবে না। ১১। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি নিষিদ্ধকরণ :সাবধান, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। এ বাড়াবাড়ির কারণে তোমাদের পূর্ববর্তী বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। ১২। রক্তপাত নিষিদ্ধকরণ :তোমরা ঝগড়া ও রক্তপাতে লিপ্ত হইওনা। মনে রেখ, তোমরা পরস্পর ভাই ভাই। সমগ্র বিশ্বের মসুলমান এক অবিচ্ছদ্যে ভ্রাতৃসমাজ। ১৩। নবুয়তের পথরুদ্ধকরণ :মনে রাখবে আমার পর আর কোন নবীর আগমণ ঘটবে না। তোমাদের পর আর কোন উম্মত আসবে না। ১৪। শিরক নিষিদ্ধকরণ :৪টি উপদেশ মনে রাখবে। শিরক করবে না, অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করবে না, চুরি করবে না এবং ব্যাভিচারে লিপ্ত হবে না। এছাড়া একমাত্র আল্লাহ ব্যতিত আর কারো সামনে মাথানত করবে না। ১৫। শ্রমিকদের মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা :হে লোক সকল দুর্বলের ওপর অত্যাচার করবে না। সাবধান শ্রমিকের মাথার ঘাম শুকাবার পুর্বেই তার উপযুক্ত পারিশ্রমিক পরিশোধ করে দিবে। ১৬। ঘুষ নিষিদ্ধকরণ :তোমরা ঘুষ দেয়া ও নেয়া থেকে বিরত থাকবে। এটা মহাপাপ। ১৭। হিংসা পরিহারকরণ:তোমরা হিংসা পরিহার করবে। মনে রাখবে হিংসা মানুষের সত্গুনগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। ১৮। শ্রমের মর্যাদা :মনে রাখবে নিজ হাতে উপার্জন করা সম্পদ থেকে উত্তম সম্পদ আর নেই। ১৯। জ্ঞান অর্জনের গুরুত্বারোপ :মনে রেখ বিদ্বানের কলমের কালি শহীদের রক্ত অপেক্ষা মুল্যবান। তোমরা জ্ঞান অনুসন্ধান কর। জ্ঞান অর্জন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর অবশ্য কর্তব্য। ২০। প্রতিবেশীর অধিকার :হে লোক সকল, মনে রেখ যে পেট ভরে খায় অথচ তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে সে প্রকৃত মুসলমান হতেপারে না। সমাজে অন্যদের প্রতি সে রকম আচরণ করবে, যে রকম আচরণ তোমরা নিজেরাও কামনা করে থাক। ২১। পিতা-মাতার সাথে উত্তম ব্যবহার :হে মানবমন্ডলী, মনে রেখ, পিতা-মাতার সন্তুষ্টিই আল্লাহ সন্তুষ্টি। তোমাদের বেহেশত তোমাদের মাতার পদতলে। ২২। মানবতার সেবা সম্পর্কে :তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ, যে মানুষের উপকার করে। ২৩। আল্লাহকে ভয় করা :হে লোক সকল, তোমরা সাবধান থেকোঃ পরকালে কেউ কারো কোন উপকারে আসবে না। তোমাদের প্রতিটি কৃতকর্মের হিসাব আল্লাহর দরবারে অবশ্যই দিতে হবে। সুতরাং মানব জীবন ও সামাজিক মুল্যবোধের কথা বিবেচনা করে কোন অবস্থতেই দুর্বল ও অসহায়ের ওপর নির্যাতন করবে না। তোমরা আল্লাহকে ভয় করবে। ২৪. পথভ্রষ্ঠ না হবার উপায় :হে বন্ধুগন, আাামি তোমাদের জন্য দুটি বস্তু রেখে যাচ্ছি যতদিন এ দুটি বস্তুকে আকড়ে ধরে রাখবে ততদিন তোমরা পথভ্রষ্ঠ হবে না। একটি হল পবিএ কুরআন, আর অপরটি হল আমার সুন্নাহ। ২৫. বিশেষ উপদেশ : আর একটি বিশেষ উপদেশ হলো তোমরা পাচঁ ওয়াক্ত নামায কায়েম করবে, রমযান মাসে রোজা রাখবে, যাকাত আদায় করবে, হজ্জ সম্পাদন করবে এবং শাসন কর্তার নির্দেশ মেনে চলবে। হে বন্ধুগণ, যারা এখানে উপস্থিত আছো, তারা আমার এ পয়গাম অনুপস্থিতগনের নিকট পীেঁছে দিবে। উপরোক্ত গুরুত্বপূর্ন ভাষন দেয়ার পর বিশ্বনবী (স.) বললেন, হে আল্লাহ ! আমি কি রিসালাতের গুরুভার বহন করতে পেরেছি? আাামি কি আমার দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি? তখন উপস্থিত জনগন উচ্চস্বরে বললেন, হ্যাঁ । এরপর আল্লাহর নবী (স.) বললেন, হে আল্লাহ তুমি সাক্ষী থেকো। তখন কুরআনে শেষ আয়াত অবতীর্ণ হয়—আল ইয়াওমা আকমালতু লাকুম দ্বীনাকুম—আজকের দিনে ইসলামকে আমি পরিপূর্ণ করে দিলাম। এরপর তিনি উপস্থিত জনমণ্ডলীকে লক্ষ্য করে বললেন বিদায়! বিদায়!! বিদায়!!!
আ ক ম আজাদ আস্ক প্রশ্ন ডটকমের সাথে আছেন সমন্বয়ক হিসাবে। বর্তমানে তিনি একজন শিক্ষক। আস্ক প্রশ্ন ডটকমকে বাছাই করে নিয়েছেন জ্ঞান আহরণ ও জ্ঞান বিতরণের মাধ্যম হিসাবে। ভবিষ্যতে একজন বক্তা ও লেখক হওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছেন। এই আশা পূর্ণতা পেতে সকলের নিকট দু'আপার্থী।